Wednesday, May 1, 2013

দ-হ-ন (ছোট গল্প)



বাবুল ডি' ন ক রে ক




এক 

আকাশ আর পূর্ণতা' র  জম্মের পর রূপার একটু কষ্টই হচ্ছিলো। এক ছেলে সন্তান থাকলে মানুষ করা যায় না এমন ধারণাও ছিলো তার বেশ প্রবল! আর তার স্বামীবরও  ভাবল, মনে হয় ৩ সন্তান হলে মন্দ হবে নাঃ একজন ডাক্তার, একজন জন ইঞ্জিনিয়ার আর আরেকজন তাদের মত শিক্ষক হোক (তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের, স্কুল কলেজের না!); রূপা চাইছিলো তাই; চাইছিল অমিতও । আর তাদের ত আসলে ৩ বা ৪ জন সন্তান নেওয়ার সাধ্য রয়েছেই এমন ভাবও ছিলো প্রবলভাবেই দু'জনের মধ্যেই। 

রূপা চাইছিলো ঝুট-ঝামেলা যা করার একবারে শেষ করে ফেলবে, ছেলে-মেয়ে তাড়াতাড়ি নিয়ে, মানুষ করে একটু ফ্রি থাকবে! জামাইটারে নিয়ে তিরিং বিরিং করে ঘুরে বেড়াবে এদেশ, ওদেশ! অমিতও তার সাথে হ্যা, হ্যা করছে সবকিছুতে। আসলে অমিত তার কোনকিছুতেই খুব বেশি দ্বিমত করে  না। হয় ত সঙ্গত কোন কারণ আছে (!) যা আমি জানি না। সে সব সময় 'আমার মনে হয় ভাল হবে; খারাপ হবে না; মন্দ নয় আইডিয়াটা' ---এমন সব কথা বলে বেশির ভাগ সময়েই রূপা কে খুশি রাখে। ভালোবাসা টা প্রকাশ করে ঐ ভাবেই! আসলে অমিত এই সব নিয়ে খুব একটা ভাবেও না! রূপা খুব খুশি হয় আর অমিতের খুব ভালোলাগে তাঁকে খুশি দেখতে।



দুই

 চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগেই সোনা চলে এলো! সোনা গর্ভে এলো আর  রূপা খুব অসুস্থ্য হয়ে পড়লো! শারীরিক অবস্থা খুব খারাপের দিকে গেলো! অমিতের ডাক্তার বন্ধুরা পরামর্শ দিলো, 'খুব ঝুঁকি হয়ে যাচ্ছে; তোমার ডিসাইড করা উচিত বউদিকে সেভ করবে? না সন্তান সেভ করবে?' অমিত খুব দুশ্চিন্তায়। একবার ভাবল --এক ছেলে এক মেয়ে আছে, ক্যান রিস্ক নেবে সে? আবার ভাবল, 'আমি বাবা হয়ে কেন সন্তানের এমন চাইছি? আমি কি নিজের সন্তানের খুনি হওয়ার নিজেই সিদ্ধান্ত নিচ্ছি না? না, না, আমার সন্তান সেভ করা উচিত!'  আবার ভাবে, আমি রূপাকে হারাতে চাচ্ছি কেন? ' টু বি অর নট টু বি' এই সব ভাবতে ভাবতে  অমিত অস্থির। ঘুম হয় না তার ইদানীং... সিগারেট টানে আর খুব ঘামে সে সারারাত! অমিতের বালিশ ভিজে যায়... নিজেকে নিয়তির কাছে বড় অসহায় মনে হয়। 

একবার ভাবল, রূপার সাথে খুলে কথা বলবে এই নিয়ে। আবার ভাবে থাক। 'শুধু শুধু ওর কষ্ট বাড়াই কেন?' তবু কথা বলে সে। সরাসরি না, তাকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বুঝায়, 'আসলে আমাদের সন্তান নেওয়ার ডিসিশনটা ভুল হয়ে গেছে! আর ডাক্তার আমাকে টেলিফোনে যা বললেন আমি তা অনেক টা এমন, ' তোমার শরীর- স্বাস্থ্য ভালো যাচ্ছে না, ঔষধ খেতে হচ্ছে প্রচুর; এই অবস্থায় সন্তান নিলে সন্তানের জন্য ক্ষতি হতে পারে ! অস্বাভাবিক সন্তান আসতে পারে! এমন হতে পারে সন্তান অথবা মাকে সেভ করার প্রশ্ন আসতে পারে।' এই কথা শোনে রূপাও খুব বিচলিত। কিন্তু রূপাও  চায় সন্তান বাঁচুক! নিজে যদি মরতেও হয়, সে সন্তানকেই বাঁচাবে...


চোখ বন্ধ করে ডিসিশান টা নিয়ে ফেলে মনে মনে অমিত। রূপাকেই সেভ করব সে।  রূপাকে  মানসিকভাবে প্রস্তুতি নিতেও বলল। রূপা খুব কান্না-কাটি করছে। অমিত ভাব দেখাচ্ছে সে খুব শক্ত, কিন্তু ভেতরে ভেতরে খুবই নার্ভাস সে।  অমিত তার স্ত্রীকে বলে, 'এক ছেলে এক মেয়ে আছে আমাদের। আর সন্তানের দরকার নেই!  আমরা আজই ময়মনসিংহ যাচ্ছি... ।' 'তুমি এত নিষ্ঠুর পিতা; তোমাকে আসলে দেবতার মত ভাবতাম আমি! কিন্তু তুমিও অতি সাধারণ মানুষ! খুব স্বার্থপর তুমি! প্লিজ একা থাকতে দাও। আমার সামনে থেকে যাও প্লিজ... ' বলে কপাল কুচকায় রূপা! অমিত চোখ বড় করে বলে, 'It's my final decision. The unknown one (baby) is future! I care for the present only!  Don't bother please! Get ready. I need wife, not more children!' 


তিন 

ডাক্তারের জন্য অয়েইট করছে আর খুব ঘামছে অমিত । ডাক্তার পরীক্ষানিরীক্ষা করে বললেন, 'সন্তান ব্যথামুক্ত অবস্থায় অপসারণ সম্ভব! এক-দুইমাস এমন কিছু নয় এবং এজন্য দুই থেকে ৫ মিনিট সময় লাগবে মাত্র! ভয়ের কিছুই নেই! আমরা ৩ মাস পর্যন্ত কোনরকম সমস্যা ছাড়াই ক্লিয়ার করতে পারি! আর খরচটাও খুবই সামান্য, ৬ হাজার টাকা, যদি ব্যথামুক্ত এম আর চান!' অমি বলল, 'এক্সকিউজ মি ডাক্তার, ৫ মিনিট পর আমরা আসছি!' এই বলে রূপাকে বাইরে নিয়ে আসল হাত ধরে! বলল, 'রূপা, আমি খুব দুঃখিত এবং বিব্রত! আমি... আমি মানিব্যাগ আনতে ভুলে গেছি! কাল আসি আবার? চল আজ চলে যাই!' সে ফ্যাল ফ্যাল করে অমিতের দিকে একবার তাকাল আর বলল, 'আমি একবার ভাবলাম তোমাকে বলি তুমি টাকা নাওনি সাথে; তুমি সবসময় এমনই, চলো... ডাক্তার কে বলে যাবে না?।' এর পর অনেকক্ষণ দুজনের মধ্যে আর কোন কথা হলো না... 

অমিত রূপাকে নিয়ে প্রেস ক্লাবে গেল। গেলো কফি হাউজেও... তার প্রিয় খাবার চিকেন বিরিয়ানি খাওয়াল! রূপা আসতে করে বলল, 'বিল দেওয়ার টাকা আছে ত?' অমি বলল আছে...



চার 

গাড়িতে বাড়ি ফিরছে তারা । এক ঘন্টার জার্নি। অমি সারা রাস্তা রূপার হাত ধরে চুপচাপ বসে আছে। কোন কথা হল না এর মধ্যে...

বাড়ি পৌঁছে অমি বলল, 'রূপা, একটা কথা বলি?'
- বল, কি? কি কথা? খুব নিচু স্বরে রূপা জিজ্ঞেস করে। 
- তোমাকে মিথ্যে বলেছিলাম আমি টাকা নিতে ভুলে গেছি! স্যরি ... আসলে আমি সন্তানকে সেভ করতেই মিথ্যে বলেছিলাম। মানিব্যাগটা পকেটেই ছিলো...
- তার মানে? 
- তার মানে, বাবা হিসেবে আমার সন্তানকে সেভ করা উচিত! এই কথা বলে অমিত মাথা নিচু করে... চিৎকার করে কাঁদতে মন চায় তার, কিন্তু পুরুষদের কাঁদতে নেই! তাই সে কাঁদে না, একটা দীর্ঘশ্বাস বুক চিরে বেরিয়ে আসে শুধু... 
- অমিকে দুই হাতে ধরে রূপা বলল, 'মা হিসেবেও আমারো তাই করা উচিত, উচিত না? আমি খুব লাকি তোমার মত একটা ছেলে আমার হাসব্যান্ড আমি পেয়েছি! Believe me, I feel proud for you. I honour your decision! সত্যি আমি খুশি তোমার ডিসিশানে! আমি হাসতে  হাসতে মরতে পারব  আমার সন্তানের জন্য। কিন্তু আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি অমিত' বলে অমিতকে জড়িয়ে ধরে রূপা হাউ-মাউ করে কাঁদে... 



এর পর দুজন কতক্ষণ চুপ ছিল তারা কেউ জানে না... এক ঘন্টা! দুই ঘন্টা! কি জানি... সন্ধ্যা নামে, বাতি জ্বলেনি ঘরে আজ। অন্ধকারে দুই মানব-মানবী পাশা-পাশি বসে জীবনের জটিল হিসেব কষে চলে! 

 অমিতই  বলল... 
-  তুমি রাগ করলে?
-  না, কেন রাগ করব? 
- এই যে আমি সিদ্ধান্ত পাল্টালাম!
- বাবা হিসেবে যা করার, তুমি ত তাই করছ! 
- হুম। আমি আর ভাবতে পারছি না রূপা, সব কেমন উলট পালট লাগছে...
- ডোন্ট অরি, সব ঠিক হয়ে যাবে। সব ঠিক হয়ে যাবে... 


পাঁচ 

যে সন্তানের জন্য অমিত তার রূপাকে কে হারাতে চেয়েছিল... আর রূপা তার জীবন দিতে প্রস্তুত ছিলো... সেই মেয়ের জম্মদিন,  আজ তার জম্মদিন! ওর নাম পরি! পরীর মত সুন্দর সে। এই পরির জম্মদিন এলেই একটু একটু ঘামে অমিত! কারণ টা খুব সিরিয়াস কিছু না, কিন্তু খুব সিরিয়াসও। পরী বা রূপা নিশ্চয়ই কোনদিন তাকে ক্ষমা করবে না, এমন চিন্তা শুধু শুধু! 

তাদের দুই ছেলে-মেয়ে খুব তাড়াতাড়ি কথা বলা শিখেছিলো। এই পরি যখন ২ বছরেও কথা বলছিলো না অমিত  ধরেই নিয়েছিল মেয়েটি বোবা! শুধু ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে মুছকি হাসি দিত! ওর মা  কষ্ট পাবে মনে করে কখনো বলেনি! রূপাও মনে মনে এই রকমই নাকি ভেবেছিলো! ঈশ্বরকে ধন্যবাদ তাদের সব ছেলে-মেয়েই অনেক গুছিয়ে কথা বলে!  

এই পরি মেয়েটা খুব হাসি খুশি, একদম দিল খোলা, চঞ্চল, চপল আর সারাদেশ ঘুরে বেড়ানো মেয়ে। বাবা-মা ছেড়ে অন্তু মামা-র (রূপার কাজিন) সাথে ঘুরে বেড়ানো তার শখ! একদম এক বছর বয়স থেকে মামার মটর সাইকেলে চড়ে দূর-দূরান্তে চলে যায়! ক্লাশে বরাবর প্রথম হয়, তাই তাকে মেধাবি বলাই যায়! হৈ চৈ করে থাকা তার স্বভাব! 

মেয়েটার প্রায় প্রত্যেক জম্মদিনে একটা না একটা প্রব্লেম হয়। আত্মীয়- স্বজনদের মধ্যে কত কী হয়! কেউ মারা যায়; নতুবা কারো বিয়ে অথবা আন এভয়েডেবল প্রোগ্রাম থাকে অথবা তীর্থ  থাকে! এবারো তার জম্মদিনে বারোমারী তীর্থ। এইবার সে প্রতিবাদ করেই বসেছে! তার অভিযোগ সবার জম্মদিন ঘটা করে পালিত হয় বাড়িতে, শুধু তার টাই হয় না! ওর দিদি পূর্ণতা ক্লাশ সিক্স পড়ে। তার মতে, 'তোর জম্মদিন্টা একটা কুফা!' পরি তা মানতে নারাজ। সে বলে, 'আমার জম্মদিন্টাও শুভ; মানুষ কুফা বানায়!'


দাবী আদায়ে সে খুব সোচ্চার। যে টা সে একবার চাইবে, সেটা না পাওয়া পর্যন্ত বিভিন্ন কায়দায় চাইতেই থাকবে। ছোটদের হলে/ তার সাধ্যের মধ্যে থাকলে সে বল প্রয়োগও করবে। আর তার মামা-র কাছে হলে গায়ে হাত তুলে হলেও। কেউ যদি অন্যায় করে তবে সে তার প্রতিবাদ করবেই (বড় হলেও)।


ছয়

তার ভাই-বোন বাবার সাথে ঢাকায় থেকে পড়াশুনা করত। পরি আর অরি  থাকে তাদের মায়ের সাথে গ্রামে। পরিও ঢাকায় বাবার কাছে থেকে পড়াশুনার বায়না ধরলো। খাওয়া দাওয়া ছেড়ে স্ট্রাইক শুরু করলে তাঁকেও ঢাকায় আনা হলো।  অমিত ভাবছিল পুরো ফ্যামিলিটাই ঢাকায় শিফট করে ফেলবে। সে দুটো জব করে ঢাকায়। একটি পত্রিকায় সাব-এডিটর আর একটা কলেজে পড়ায়। আবার ৩ ছেলে-মেয়ের যত্ন- আত্তি করা, তাদের পড়াশুনার তদারকি করা একটু টাফ ই! 

একদিন কলেজ থেকে আসামাত্র মেয়েটি  তার বাবাকে জড়িয়ে ধরে হাউ-মাউ করে কাঁদতে শুরু করলো । কোনমতেই তাকে আর থামানো যাচ্ছে না! পত্রিকা অফিসে যাওয়ার সময় হয়ে এলো কিন্তু সে তার কান্না থামাচ্ছে না। তার দিদিকে জিজ্ঞেস করল অমি কিন্তু কোন উত্তর পেল না। 

অনেক কষ্টে তার কান্না থামানো গেলো...
সে বলল, 'বাবা, আমার এখানে দম বন্ধ হয়ে আসছে! তুমি আমাকে মায়ের কাছে নিয়ে চলো! আমি মরে যাচ্ছি!'
ওর কথা শুনে অমিতও কেঁদে ফেল্ল ... ক্লাশ ওয়ানে পড়া মেয়ের দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে আর তার বাবা কি শ্বাস নিতে পারে!

অমিত বলল, 'মা মনি, কাঁদে না; আমরা আজি গ্রামের বাড়ি চলে যাবো! কি হয়েছে বল?'

সে বলল, 'আমাদের এক টিচার বলেছে, তোর দ্বারা কিচ্ছু হবে না! কেনো তিনি এইটা বলছেন?  আমি কি এত গাধা যে আমার দ্বারা কিছুই হবে না? আমি এই স্কুলে আর পড়বো না, আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে। বাবা, আমাকে মায়ের কাছে নিয়ে চলো, আমি শ্বাস নিতে পারছি না; আজকেই চলো... বলে আবারো চিৎকার করে কান্না!' অগত্যা  অফিস কামাই দিয়ে মেয়েকে নিয়ে রাতেই বাড়ি ফিরল তার বাবা!  


সাত 

মেয়ে বড় হচ্ছে! দেখতে দেখতে কবে চতুর্থ ক্লাশে উঠে গেছে! 'মেয়ে বড় হলে একদিন ঐ বিষয় টা জানবেই কোন না কোনভাবে। গোপন করেই কি লাভ! আমি বা রূপাই হয় ত একদিন বলে দেবে মেয়েকে! তাই আর গোপন করার চেষ্টা না করলাম! আমার মেয়ে কি আমাকে ক্ষমা করতে পারবে যখন জানবে---আমি নিজের সুখের জন্য তাকে মেরে ফেলতে চেয়েছিলাম? রূপা ই কি মনের ভুলে কখনো ভাবে না, আমি মেয়েকে বাঁচানোর অজুহাতে তাকে মেরে ফেলার ডিসিশন নিয়েছিলাম!' মনের অজান্তে এই সব একা একা ভাবে আর ঘেমে উঠে সহসা অমিত। 

অমিত মনের অজান্তে ভাবে, 'ক্ষমা চাইলেই কি তার সীমাহীন ভুলের ক্ষমা মিলবে?  অমিত দুঃখের দহনে পোড়ে। এই দহন শেষ হবার নয়...

No comments: