Thursday, May 2, 2013

একরাত্রি (ছোট গল্প)






একরাত্রি 


বাবুল ডি' ন ক রে ক 


এক।।

হাই স্কুলের যখন ছাত্র ছিলাম, তখনই স্বপ্ন দেখতাম শিক্ষক হব। আর শিক্ষক যদি হই তবে গ্রামের কোন প্রাইমারী স্কুলেই পড়াব এমন সিদ্ধান্তই ছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স করে বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস এর প্রশাসন ক্যাডারের জন্য আবেদন করলাম। চাকুরী টা হয়েও গেলো। সে চাকুরীতে যোগদান না করে গ্রামের একটি মিশনারি প্রাইমারী স্কুলে যোগ দেয়াতে আমার বন্ধু - স্বজন মোটেও খুশি ছিলো না। বন্ধুর সাথে ছাড়াছাড়ি পর্যন্তও গড়ায় শেষ পর্যন্ত। অবন্তী নামের মেয়েটিও আমার কাছে একটা স্বপ্নের মত ছিলো! সে যাই হোক অবন্তী আমার জীবনের স্বপ্ন ছিলো ঠিক, কিন্তু মানুষ গড়ার কারিগর হবার স্বপ্নের কাছে হার মেনেছিলো আর একটি স্বপ্ন!

বিসিএস এ যোগদান না করার ঘটনা দ্রুত ছড়িয়ে গেলো পরিবারের কানেও! এ নিয়ে বন্ধু মহলে হাসির রোল পড়ে গেল। টক অফ দ্য ফ্রেন্ড সার্কেল ত বটেই, বন্ধুদের সীমানা পেরিয়ে অভিভাবক মহলে টপিক্টার ঢেউ আছড়ে পড়ল! আমার বাবা প্রাইমারীর টিচার। খুব কড়া প্রকৃতির মানুষ। তিনি আমাকে সালাম দিয়ে পাঠালেন।




দুই।।

বাড়িতে ঢুকেই একটু হোঁচট খেলাম। ছোটখাটো বিচার সালিশ জাতীয় কিছু মনে হল। কাঁধের ব্যাগ নামানো গেলো না। অমনি আমার বাবা খেঁকিয়ে উঠলেন...
-তুই নাকি বিসিএস এর চাকুরীটায় জয়েন করছিস না? আমি ঠিক শুনেছি?
-না বাবা। জয়েন করছি না, তুমি ঠিক শুনেছ।
- তা কি করবে শুনি?
- তোমার মত মাস্টারি করব...
- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পড়ে প্রাইমারীতে পড়াবি? মাথা ঠিক আছে ত? মান-সম্মান বোধটাও তোর নাই? সেলফ ডিগ্নিটি বলে একটা ইংরেজি শব্দ আছে, জানিস?
- এতে মান-সম্মানের প্রশ্ন আসছে কেন?
- ছি ছি ছি ছি। পাড়ার সবাই হাসাহাসি করছে। ছেলেটা পাগল হয়ে গেছে বলছে।
- অন্যের বলাতে কি আসে যায়?
- মুখে মুখে তর্ক করিস! লজ্জা নাই তোর? মানুষ হ মানুষ!
- কোথায় তর্ক করলাম? আমি ত তোমার প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছি...
- বিসিএর চাকুরী টা করবি না কেন? আমরা জানতে চাই? 
আমি একটা লম্বা বক্তৃতা করলাম। বললাম...
- সবারই জীবনে স্বপ্ন থাকে। আমারও একটা স্বপ্ন আছে। আমি যদি এই চাকুরীতে জয়েন করি, আমি ম্যাজিস্ট্রট হব। মান্দিরা আর মধুপুরবাসীরা গর্ব করে বলতে পারবে, আমাদের ছেলে ম্যাজিস্ট্রেট! তারপর? একদিন ইউএনও, এডিএম, এডিসি, ডিসি হব! শেষ বয়সে গিয়ে হয় তো সচিব হব। দেশের জন্য, দেশের মানুষের জন্য কাজ হয় তো করার সুযোগ হবে। অনেক নাম কুড়াব। যা হব, তা আমি একাই হব। কিন্তু আমি মনে করি, আমি তা না করে শিক্ষক হলে আমি শত শত ছেলে মেয়েকে ম্যাজিস্ট্রেট, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, শিক্ষক, সাংবাদিক, লেখক, গবেষক, সচিব বানাতে পারব! আমার ছাত্ররা মন্ত্রী হবে, দেশ চালাবে। জাতি সংঘের মহাসচিব হবে। সারাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়বে তারা একদিন। তারা সারা পৃথিবীর মানুষের কল্যাণে কাজ করবে... বাইবেলে বর্ণিত 'গমের দানা' না হয় আমিই হলাম। যাকে মাটিতে পড়তে হবে, মরতে হবে, তা না হলে ঐ একটা বীজ ই থাকবে! আমি একা ম্যাজিস্ট্রেট হতে চাই না... আমি চাই ...
আমার কথা শেষ না হতেই আমার বাবা চেয়ার ছেড়ে দাঁড়ালেন! আমি ভাবছি ঠাস করে চড় বসিয়ে দেবে না তো! নাহ! চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। কঠিন মানুষ টা নীরবে কাঁদলেন! বললেন, আমি খুব খুশি বাবা, তুমি মানুষ হয়েছ! অনেক বড় মানুষ হও। দোয়া করি।

তাকিয়ে দেখলাম, সবার চোখে জল!

এইবার আমার মা-ও কান্না-কাটি শুরু করে দিল। সে কান্না আনন্দের কি না বুঝা গেলো না। আমি ভাবলাম তাঁকে বলি, 'মা, আমি আর মাস্টারি করব না। তোমাদের ইচ্ছেই আমার ইচ্ছে।' কিন্তু বলা হলো না। আমার ছেলেবেলার স্বপ্ন আমি গ্রামের কোন প্রাইমারী স্কুলের টিচার হবো। আমার পুরো হিদয় জুড়ে সে স্বপ্ন বাসা বেঁধেছে। তা একদিনের বাণে ভেসে যাবার নয়! ভালোবাসা বাণে ভেসে যায়, স্বপ্ন চিরঞ্জীব। স্বপ্ন ভাসে না, শুকোয় না, 'স্বপ্ন মরে না কখনো!'





তিন।।

জলছত্র মিশনের উত্তরপূর্ব পাশের শালবনের মাঝখানে একটা গ্রাম। শ্যামলে - সবুজে ঢাকা। গ্রামের নাম গায়রা। মিশন থেকে গ্রামের দূরত্ব ৪-৫ মাইল হবে বোধ করি। পচিশ মাইল থেকে একটা তিন চাকাওয়ালা ভ্যান ভাড়া করলাম ১০ টাকায়। গভীর কালো শালবন। তাঁর মাঝখান দিয়ে আমি আর ভ্যান চালক টেলকীর দিকে যাচ্ছি। টেলকী থেকে গায়রার দূরত্ব মাইল খানেক হবে শুনেছি। আমার হাতে অধ্যাপক কবি আবুবকর সিদ্দিক এর ছোট গল্পের একটা সংকলন। বইটির 'শালবন ধর্ষণ' গল্পটি পড়ছিলাম এখানে আসার আগে। মধুপুর, জলছত্র, টেলকি, নয়াপাড়া, গায়রা এলাকার গারোদের জীবন সংগ্রাম, বন বিভাগের বন ধংস, আদিবাসীদের বিরুদ্ধে অজস্র মিথ্যা মামলা, তাঁদের ভূমি, জীবন সংস্কৃতি সরকার কর্তৃক ধ্বংস করার নীলনকশা অত্যন্ত মর্মস্পর্শী ভাষায় তুলে ধরা হয়েছে। পড়তে পড়তে চোখ ভিজে আসছিল! নিজেকে বুঝাই, ছেলে মানুষকে কাঁদতে নেই। যা আমার বাবা সব সময় বলতেন! আমি সব ফেলে, সব হারিয়ে গ্রামে ফিরছি এই সব থেকে মানুষকে মুক্তির পথ দেখারবার জন্যেই! ছোটখাটো সেনাপতি গোছের আমিও! সেনাপতিরা কাঁদে না! মনে মনে বলি।

এখানে আসার আগে আমি কলামিস্ট ও সংস্কৃতি কর্মী সঞ্জীব দ্রং এর বেশ কয়েকটি বই পড়েছি। সাবেক জেলা রেজিস্ট্রার, গারোরা যাকে বিশিষ্ট চিন্তাবিদ বলে মানেন তাঁর বইও পড়েছি। এ ছাড়া 'মাননীয় প্রধান মন্ত্রী ঃ ঘুম নেই আবিমায়', কবি ও গল্পকার ফিডেল ডি' সাংমা, কবি বচন নকরেক, কবি অপূর্ব ম্রং, কবি লুই চিরান, হেড মাস্টার এপ্রিল পল মৃ্‌ , বাবুল দারু, ফ্রান্সিস রেমা, প্রিন্স প্রান্নাথ রেমা, জর্জ নকরেক, প্রশান্ত চিরান এর গল্প, কবিতাও পড়েছি। জেমস জরনেশ চিরানের 'জলছত্রের জোনাকী' আর কবি মত্যেন্দ্র মানখিনের মধুপুর নিয়ে, সেখানকার লড়াই- সংগ্রাম- আন্দোলনের কবিতাও পড়েছি অল্প বিস্তর। পাভেল পার্থ এর 'বনলশাল ব্রিং' আর তুখোড় সাংবাদিক ফিলিপ গাইন এর 'দ্য লাস্ট ফরেস্ট অব বাংলাদেশ' বইটা বলতে গেলে আমি অনেকটা মুখস্তই করে ফেলেছি। আর মিসিগান বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড রবিন বারলিংস এর 'দ্য স্ট্রং উইমেন অব মধুপুর' টা একবার পড়েছি। জুঁই মৃ্‌ এর 'গৃহকোণে তার ছেঁড়া গীটার হব যদি কষ্ট দাও' এর মত অসংখ্য লাইন আমার হিদয়ে। তৃপ্তি চিসিম মনি ও বাবুলের লেখা 'বাংলাদেশে আদিবাসীদের সাংবিধানিক স্বীকৃতিঃ স্বপ্ন, বাস্তবতা ও সম্ভাবনা' এর ইংরেজি অনুবাদটাও পড়েছি। নাট্যকার নিশিকান্ত মাজি'র লেখা 'আনালং গোনালং', 'দিগগি বানদি' টা কলেজে থাকতেই পড়েছিলাম! বিশ্ববিদ্যালয় পড়ার সময় একবার শর্ট ফিল্ম করার চিন্তাও করেছিলাম! হয়ে উঠেনি। তবে সব মিলিয়ে বলতে পারি, যেখানে যাচ্ছি সে এলাকার মানুষ, তাঁদের ক্ষয়ে যাওয়া জীবন, তাঁদের বেঁচে থাকার নিরন্তর সংগ্রাম, তাঁদের শিল্প, সাহিত্য সম্পর্কে আমার একটু আধটু ধারণা আছে!

তাঁদের লেখা পড়েই জেনেছি, এখানে গারোদের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে নেতৃত্ব দিতে গিয়ে, লড়াইয়ে শামিল হতে গিয়ে খুন হয়েছেন আদিবাসী নেতা বীর চলেশ রিছিল, গিদিতা রেমা, স্কুলের হেড মিস্ট্রেস বাসন্তী মাংসাং, অধীর দফো, নিন্তনাথ হাদিমা, সেন্টু ন ক রেক, শহীদ পীরেন স্নাল, বীহেন নকরেক, নিবাস ম্রি প্রমুখ। অধিকার আদায়ের মিছিলে পুলিশের গুলিবিদ্ধ হয়ে চিরতরে পঙ্গু হয়ে যাওয়া বীর উৎপল নকরেক এর কথাও বাগাছাস, গাসু, আজিয়ার ম্যাগাজিন গুলোতে পড়েছি আর মাঝে মাঝে ভেবেছি, আমি গ্রামে ফিরে গিয়ে ওদের মত জীবনের ঝুঁকি নিতে যাচ্ছি না তো!





চার ।।

টেলকি পৌঁছেই একটা ছোট ধাক্কা খেলাম। আমাকে স্বাগত জানানোর জন্য গ্রামের কয়েকজন মাতব্বর এসেছেন পায়ে হেঁটে। যাঁদের বাড়িতে আমার থাকার আয়োজন, সে বাড়ির কর্তা এসেছেন। সাথে তাঁর ৭-৮ বছরের একটা পিচ্ছি ছেলে। আপেলের মত লাল দুটো গাল। গোলগাল চেহারা। বোকা বোকা চাহনি। পা-পোছের মত ঘন, কালো চুল!
আমি ভ্যান থেকে নামতেই সবাই নমস্কার দিলো। পিচ্ছি টা নমস্কার দিয়ে হাতটা নমস্কারের ভঙ্গিতেই বুকের কাছে রেখে দিয়েছে। খুব সুন্দর লাগছে! আমি তাঁকে কোলে নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম...

-তোমার নাম কি?
-রৌদ্র
-বাহ! খুব সুন্দর নাম।
-থ্যাংকয়্যু
-ওয়েলকাম
-কিসে পড় তুমি?
-ক্লাশ ওয়ান পাশ করেছি। টু পড়ব...
-তুমি ত অনেক বড় ক্লাশে পড়!
-আমার দিদি আরো বড় ক্লাশে পড়ে...
কথাটা শুনে হাসি পাচ্ছিলো... কিন্তু হাসলাম না। কথা শুনে রৌদ্রকে মেধাবী মনে হলো না মোটেও। এমন বোকা একটা ছেলের সাথে বন্ধুত্ব করতে হবে ভেবে একটু চিন্তান্বিত হলাম...।।

আমি অবাক হলাম। বোকা বোকা চেহারার ছেলেটাই ক্লাশ টু'র ফার্স্ট বয়! যত দিন যায়, তত এই বোকা ছেলেটার মধ্যে নিজের ছবি দেখি! খেয়াল করলাম সে পাঠ্যবইয়ের বাইরে কিছু বই পড়ে যা অন্য কেউ ঐ বয়সের ছেলে-মেয়েরা পড়ে না! এই যেমন কমিক্স, কার্টুন, সিন্দাবাদ, রাক্ষস কক্ষসের গল্প, রহস্য পত্রিকা, ভবেশ রায়ের লেখা বই, গোপাল ভাঁড়ের কমিকস, ছোটদের রবীন্দ্রনাথ, ছোটদের শেক্সপীয়ার এই সব! কোত্থেকে সে এই সব বই পায়? সেই আমাকে বলল, 'আমার মেজো মামা ঢাকায় ব্রিটিশ হাই কমিশনে চাকুরী করে। সেই আমাকে এগুলো পাঠায়।' ওর মামার নাম অমল বলল।
সে বলে, 'আমার মামা যা ভবিষ্যৎ বাণী করে, সব অক্ষরে অক্ষরে ফলে, জানেন?'
-না বললে জানবো কি করে?
-হ্যা, আমার মামা সারাদিন সময় পেলেই বই, পত্রিকা পড়ে। সে সব জানে!
-তাই?
-জি স্যার।
-তা তোমার সম্পর্কে তাঁর কোন ভবিষ্যৎ বাণী নাই?
-আছে...
-কি সেটা?
-আমি বড় হয়ে ব্যারিস্টার হবো...
-তা তোমার কি ব্যারিস্টার হওয়ার ইচ্ছে আছে?
-নাহ
-তাহলে!
-কিন্তু মামা বলছে ত, ইচ্ছে না করলেও হয়ে যেতে পারি!
-ও মা! কেমনে?
-আমি ত ফাদার হবো! আবার নাও হতে পারি। ফাদাররা বই পড়ার সময় পায় না। আমার তো বই ছাড়া চলবে না। মূর্খ হয়ে বাঁচা থেকে না বাঁচা ভালো! তাই না স্যার? আর তারপর ব্যারিস্টার যদি হতেই হয়...
ওর কথা শেষ হয় না। মাঝে মাঝে পাগল পাগল লাগে নিজেকেও ওর সাথে কথা বললে!





৫।।


বছর কেটে গেলো গায়রা গ্রামে! আমার সাথে পিচ্ছিটার বেশ বন্ধুত্ব। ক্লাশে আমি তার শিক্ষক বটে, কিন্তু বাসায় আমরা বন্ধু! ধীরে ধীরে সে শুধু আমার হিদয়ে জায়গা করে নেয় নাই, আমার শোবার ঘরেও তার ঘুমানোর খাট রাখবার জায়গা করে নিয়েছে এতদিনে!

একটা বিষয় খেয়াল করলাম তার। রাত হলে সে একা হাটে না! ঘুমাতে গেলে লাফ দিয়ে খাটে উঠে। ঘুম থেকে উঠে খাট থেকে লাফ দিয়ে! আর এত শব্দহীন লম্ফ সে রপ্ত করেছে, বলা বাহুল্য। লক্ষ্য করলাম খুবই ভীতু ছেলেটা। রাতে চেয়ারে পা তুলে বসে। তার ধারণা চেয়ারের নীচে কত কি থাকে! পা টেনে ধরতে পারে! খাটে লাফ দিয়ে উঠলে নিরাপত্তা বাড়ে!
এক শীতের রাতে তাকে খুব অস্থির অস্থির লাগলো খুব। কি হয়েছে জানতে চাইলাম। সে বলল, 'কিছু হয়নি।' তোমাকে অস্থির দেখাচ্ছে কেন? এমন প্রশ্নে শান্ত হয়ে বলছে, 'কই স্যার! আমি ত খুব স্থিরি আছি।'

আমি আর রৌদ্র দোতলায় ঘুমাই। সে সাধারণত রাত ৯:৩০ বা ১০ টায় ঘুমাতে যায়। এক রাতে সন্ধ্যা ৭:৩০ এর দিকে ঘুমিয়ে পড়ল! একবার ভাবলাম জিজ্ঞেস করি। আবার ভাবলাম, ছেলে মানুষ। হয় তো ক্লান্ত! তাই আর ডাকাডাকিতে গেলাম না!
রাত ৪ টায় চিৎকার চেচামেচিতে ঘুম ভাংলো। কেউ একজন চিৎকার করে সবার ঘুম ভাঙ্গিয়ে দিলো! কিছুটা বিরক্ত হয়ে বাইরে এলাম। প্রায় আধা মাইল দূরের এক বুড়ো নানা গলা চড়িয়ে কথা বলছেন রাত ৪টায়! তার গলার স্বরে আসে পাশের পরিবারগুলোর লোকজন জড়ো হয়ে গেছে। বুঝার চেষ্টা করলাম কী ঘটনা! নানার কথা শুনে সবাই হাসাহাসি করছে...আমারো হাসি পেলো...তিনি বলছেন

-আমি নিজের চোখে দেখেছি, রৌদ্র আমার খেজুর গাছে উঠে খেজুরের রস...
-আমার ছেলে এই রাত ৪ টায় আপনার খেজুরের গাছে...... কোনদিন না, কোনদিন না
-আমি দেখেই বলছি
-আপনি ভুল দেখেছেন।
-আমি ভুল দেখিনি! আমি এখনো চশ্মা পড়ি না...
-রৌদ্র রাতের বেলা একা ঘরেই ঢুকার সাহস পায় না, সে ঘুমানোর আগে খাটে লাফ দিয়ে উঠে পাছে খাটের নিচে ভূত পা টা টেনে ধরে! আর এই ছেলে রাত ৪ টায়...না না না না, হতেই পারে না। আপনারাই বলেন, ছেলেটা এখনো ঘুমাচ্ছে, আর উনি বলছেন আমার ছেলে তাঁর খেজুর গাছে...

রৌদ্রর বাবা ওর মা'কে থামাতে যায়। 'আহা! তুমি রেগে যাচ্ছ কেন? ছেলে অন্যদের সাথে যেতেও ত পারে...
-তুমি তাল দিও না। আমার ছেলে কি পারে আর কি পারে না আমি জানি না? ৮ বছরের একটা ছেলে রাত ৪ টায় একা যাবে খেজুরের রস পাড়তে! গল্প শুনতে ভালোলাগে না...
উপস্থিত কেউ সে গল্প বিশ্বাস করেনি। সারাগ্রামের মানুষও না। আমি দোতলায় গিয়ে দেখলাম ছেলেটা নাক ডেকে ঘুমুচ্ছে! কিন্তু সারাগ্রাম তাকে নিয়ে ঘটনায় তুলপাড়!

পরেরদিন টক অব দ্য ভিলেজ ছিলো রৌদ্রের কাহিনী। বুড়ো নানা দোকানপাতে গিয়ে কাহিনী বলছেন আর সবাই এই নিয়ে হাসাহাসি করছেন। কেউ বিশ্বাস করছে না তাঁর কথা। কিন্তু তিনিও দমবার পাত্র নন। সকাল ১১ টার দিকে নানা স্কুলে আসলেন।
তিনি বললেন...


- 'মাস্টার মশাই, আমাকে সবাই পাগল বলছে! আপনার কি মনে হয় আমি পাগল?'
-না, আপনি তা নন...
-আপনার ছাত্র গতরাতে... আপনি বিশ্বাস করেন?
-অসম্ভব কিছু না। কিন্তু নিশ্চয়ই আরো কেউ সাথে ছিলো?
-না, আমি তাকে একাই দেখেছি...
-সেটা অসম্ভবের কাছাকাছিই বটে!
-আপনি আপনার ছাত্রকে ডাকুন...তার মুখ থেকেই শুনি!
অগত্যা আমি ছাত্রকে ডাকলাম। ছাত্র শান্ত গলায় বলল, 'স্যার, আমি ত কিছু জানি না! আমি না আপনার রুমেই ঘুমিয়েছি? আপনি দেখেন নি? '
-হ্যা, তাই ত! কিন্তু উনি যে বলছেন...
-আমি কেন যাব? আমি ত ঘরের ভেতরেই ...
-ঠিক আছে, তুমি যাও...
আমি নানাকে বললাম, দেখুন সে অনেক ছোট। সন্ধ্যার পর সে একা ঘরেও ঢুকে না ভয়ে! আর সে একা আপনার ওখানে খেজুরের রস......? কেমন খটকা লাগছে না?
-কিন্তু আমি ত তাকে দেখেছি!
-আমার কেন যেনো মনে হচ্ছে আপনি কোথাও ভুল করছেন...
-না মাস্টার, আমি ভুল দেখিনি, ভুল বলছি না, ভুল করছি না...
-আপনি আবার ভেবে বলুন!
-দেখুন মাস্টার, শুনেছি আপনি খুব বিদ্যান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মাড়াইয়া আইসেন এইখানে, মাস্টারি করছেন ওজপাড়া গাঁয়ে! আপনার ত দেখি জীবন ১৬ আনা মিছা!
-মানে?
- কী পড়ান ছাত্রদের? সব চোর ছুটটা বানাইতেছেন, মানুষ ত বানাইতে পারছেন না! কী লাভ? শহরে ফিরে যান। সরকারি চাকুরি করেন, ঘুষ খান। যত্তসব...

এই বলিয়া তিনি হ ন হন করে হেটে গেলেন...। তাঁর কথায় মনে হল, সরকারী চাকুরে সবাই ঘুষ খায়!
আমি তাঁর যাওয়া চেয়ে চেয়ে দেখলাম...বুক চিরে একটা আকাশসম দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো...
ইস! এই সময় যদি অবন্তী পাশে থাকত! কারণে অকারণে মাঝে মাঝেই অবন্তীর কথা মনে পড়ে। তখন নিজেকে খুব অসহায় লাগে! অবন্তী কি তা বুঝে? বুঝবে কি কোনদিন? বুকের ভেতর টা সমুদ্র সমান ফাঁকা ফাঁকা লাগে!





৬।।


পরেরদিন রাতে সারারাত ঘুম হলো না আমার। এপাশ ওপাশ করে রাত টা কাটল! অবন্তীর কথাও একটু মনে পড়ল! হায় অবন্তী! বেচারি জানলোই না সে কি হারিয়েছে। ছোট্ট একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো হিদয়ের গভীর থেকে। সে দীর্ঘশ্বাস বলে বুঝানোর মত নয়। আমি ভাবি, আমি ভুল করলাম না ত? অবন্তী কি সত্যি সত্যি আমাকে ভুলেই গেল? ভালোবাসা কি এমনি ঠুনকো বিষয়? কত চিঠি লিখলাম, একটিরও উত্তর করেনি সে আর! ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে ফ্যাকাল্টি হিসেবে জয়েন করেছে শুনে অভিনন্দিত করে কার্ড আর একগুচ্ছ রজনী গন্ধা পাঠিয়েছি, কিন্তু জবাব আসে নি! এত এত রাগ আর অভিমান সে কোথায় রাখে? আমি ভাবি আর ভাবি!

ভোর হয়ে এলো। কাক ডাকা ভোর। পাখির কলতানে মুখর পুরো গ্রাম। একটি অস্থির চিত্ত আমার দিকে তাকিয়ে! আমি ডাকলাম 'মেঘ', কিছু বলবে?
-স্যার, আমাকে আমার মা ছাড়া এই নামে ডাকে না! আপনি কেমনে জানলেন আমার আরেক টা নাম আছে?
- আমি সব জানি রোদ্দুর!
-আপনি আমার এই নামটাও জানেন স্যার?
-আমি তোমার আরো অনেক কিছু জানি?
-ও! স্যার আপনার আজ ঘুম হয়নি? শরীর খারাপ?
-না। ঠিক আছি। তোমার ভালো ঘুম হয়েছে?
-না স্যার। আমি সারারাত আজ চোখ বন্ধ করে রাত পার করেছি।
-কেন? কি হয়েছে তোমার? মাথা ব্যথা করছিলো?
-না, স্যার। আচ্ছা স্যার, আপনার কি মনে হয় আমি খেজুরের রস চুরি করার জন্য ঐ রাতে গিয়েছিলাম?
-না, একদম নাহ!
-কিন্তু স্যার, আমি গিয়েছিলাম। কিন্তু আমি সেটা কাউকেই বলতে পারছি না, আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে স্যার...
এই বলে ছেলে ঝরঝর করে কেঁদে দিলো। আমি তার মাথায় হাত রেখে বললাম, এই ত আমি তোমার সাথে। আমাকে বল আসলে সে রাতে কি হয়েছিল?
আমার ধারণা, রৌদ্র সে রাতে সেখানে যায়নি। সে এখন হয় ত একটা গল্প বলবে। আমি তার মুখের দিকে তাকিয়ে বললাম, কে কে ছিলে তোমরা?
-প্রশান্ত, অনন্ত, ওয়ালজান, পল, রন, জন, সালজং, সালান্তি, তপু, তুর্য সবাই ছিল।
-কিন্তু বুড়ো নানা যে বলল তুমি একাই ছিলে?
-উনি যখন আমাকে দেখেন, তখন আমি একাই ছিলাম...
-মানে!
-আমরা এক সপ্তাহ আগে নানার কাছে খেজুরের রস খেয়ে দেখার আবদার করেছিলাম। তিনি আমাদের তাড়া করেছিলেন। তাই আমরা সেদিন টিফিনে একটা প্ল্যান করি...
-তার মানে?
-আমরা চুরি করার প্ল্যান করি। এবং চুরি করে সবাই চলেও আসি!
-মাই গড! তারপর?
-স্কুল মাঠে এসে পল বলল, "শালা বুড়া, কালকে আসল খেজুরের রস খাও! আমাদের সাথে চালাকামি!" আমি তার মানে জানতে চাই। সে বলল, 'আমি খেজুরের পাত্রে হিসি দিয়ে আচ্ছি!'
-কি বলো তুমি!
-জি স্যার।
-হুম! তারপর...
-ওরা সবাই চলে গেলো...
-তারপর...
-তারপর আমিও বাসায় আসলাম। কিন্তু ঘুমুতে পারছিলাম না। আমাদের বুড়ো নানা সকালে ...খাবে ভেবে ভেবে কান্না আসছিলো। তাই আমি একাই সেটা ফেলতে গিয়েছিলাম...
-বলো কী!
-জি স্যার। ফেলতে গেলে পাতিলটা মাটিতে পড়ে গিয়ে শব্দ হতেই নানা আমার চোখে...
-কিন্তু তুমি ত খুব ভয় পাও একা!
-সেদিন থেকে আমার আর ভয় কাজ করে না...
-ভেরি গুড!
রৌদ্র আমার দিকে চোখ তুলে তাকায়। তার পুরো চোখের আকাশজুড়ে মেঘবৃষ্টি! আমি ছেলেটারে কাছে টানি। আমার হাতের ছোঁয়ায় ঝড়ের তীব্রতা বাড়ে। দুহাতে আমাকে জড়িয়ে ধরে ফুফিয়ে ফুফিয়ে কাঁদে সে! আমি অসহায়ের মত শুধু তার মাথায় হাত রাখি...



সাত ।।



দুপুরবেলা রৌদ্র কে বললাম, 'চলো বুড়ো নানার ওখানে যাই'

সে বলল, 'আমার যেতে ইচ্ছে করে না'
-তুমি স্যরি বল, উনি অনেক বড় মানুষ
-জানি স্যার। কিন্তু আমার ইচ্ছে করছে না...
অনেক বুঝিয়ে রাজী করালাম তাঁকে। সে ক্ষমা চাইবে। পা ধরেই ক্ষমা চাইবে। কারণ খেজুরের রস খাওয়ার আইডিয়া টা ছিল তারি! আর আমারো বুকের ভেতর খচ খচ করছে। আমি শুধু চোর বানাই, মানুষ বানাতে পারি না! আমার জীবন ১৬ আনা মিছে...এই সব কানে সারাক্ষণ যন্ত্রণা করে! আমি রৌদ্রের মত সাহসী ছেলেও বানাই এইটা প্রমাণ করার খুব সাধ মনে।
আমরা তৈরী হয়ে বের হব নানাবাড়ি যাওয়ার জন্য। ঠিক এমন সময় ঘন্টার আওয়াজ শোনা গেল। মিনিট দুই পর জানলাম নানা এই পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে চলে গেছেন না ফেরার দেশে!


এগুলো অনেক বছর আগের কথা...

আমি মাস্টারি ছেড়ে বাংলাদেশ থেকে স্বেচ্ছা নির্বাসনে চলে এসেছি। খুব কাছের মানুষেরা আমাকে গাড়ি চাপা দিয়ে মেরে ফেলার প্ল্যান করেছে কিছু রাজনীতিবিদদের সাথে হাত মিলিয়ে! আমার বন্ধু অনিন্দ্য এন এস আই এর জাঁদরেল অফিসার। সেই আমাকে কিছু কথোপকথনের রেকর্ড বাজিয়ে শুনিয়েছে আমাকে মারতে পারলে কে কত টাকা ভাগে পাবে! মানুষের প্রতি সীমাহীন ভালোবাসায়  একটা ছোট্ট অভিমান নিয়ে আমি দেশ ছাড়ি! ততদিনে একিউট এপিক্সট্যাক্সিস টা ক্যান্সারে রূপ নিয়েছে! খোদা চায় নাই, কেউ আমার খুনি হোক! ক্যান্সার হলে কি কেউ বাঁচে? আমার মনে হয় আমি বেঁচে যাবো! মারা গেলেই ভালো হত খুব। আমার মনে হয়। অবন্তীর একটা শিক্ষা হত!   

এই সব পাগলের চিন্তায় ঘুম আসছিল না। তাই ফেইসবুকে ঢুকেছিলাম। একটা স্কাইপ রিকোয়েস্ট আসলো 'শূণ্যমেঘ মারাক'। মারাক লেখাটা দেখেই গ্রহণ করি। আর সে অবাক করে দিয়ে আমাকে স্কাইপে কল দিলো! আমার এক এক করে ফেলে আসা সোনালী দিনগুলোর কথা মনে পড়ল। হৃদয় টা হু হু করল। রৌদ্র বলল, 

- নমস্কার স্যার, ভালো আছেন?
- নমস্কার। কে তুমি?
- আমি রৌদ্র মারাক! আপনার ছাত্র।
- ও মাই গড! রৌদ্র! কোন রৌদ্র? রৌদ্র মারাক?
- জি স্যার। আমাদের কথা আপনার মনে আছে?
- মনে থাকবে না কেন? কি খবর? কি করছ? পিএইচডি করার জন্য দেশের বাইরে আছ শুনছিলাম একবার। তারপর তোমাদের আর খোঁজ পাই না।
- না স্যার, আমি পিএইচডি টা এখনো শেষ করতে পারিনি! কিন্তু বার-এট-ল শেষ করেছি।
- অভিনন্দন ব্যারিস্টার রৌদ্র!
- থ্যাংক ইউ স্যার! আমি বিসিএস এ কোয়ালিফাই করে ফরেন মিনিস্ট্রিতে জয়েন করেছি বছর পাঁচেক আগে! এখন নিউ ইয়র্ক পোস্টিং। জাতি সংঘে আদিবাসী বিষয়ক সেমিনারগুলোতে ফার্স্ট সেক্রেটারী হিসেবে আমি এখন এটেন্ড করি বাংলাদেশ সরকারের হয়ে! আমরা আপনার স্বপ্ন এক এক করে পূরণ করে চলেছি স্যার!
- আসকি, বালশ্রী, সিল্গা, আব্রি, সিলচি, সালান্তি, তূর্য ওদের খবর কি?
- আসকি হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় এ এসোসিয়েট প্রফেসর এখন। সিল্গা জাতি সংঘের আন্ডার সেক্রেটারী জেনারেল। আর বালশ্রী-র কথা তো জানেন ই মনে হয়। সে লন্ডনে থাকে। ওখানে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে গিয়ে পলিটিক্স করত। ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালী সিনেটর এখন। আব্রিও তো জাতি সংঘে জয়েন করছে ফার্স্ট সেক্রেট্রী হিসেবে আগামী মাসে, জানেন?
- ও মা! আদিবাসীরা ছেলে মেয়েরা অনেক এগিয়ে গেলো! এই খবর গুলো তো আমি রাখিনি...
- স্যার, আরো কত কত ভালো খবর আছে! জানেন?
- না তো!
- তূর্য এম আই টি বিশ্ববিদ্যালয়ে কম্পিউটার সাইন্স পড়ায়। হোয়াইট হাউস -এ তাঁর অবাধ যাতায়াত। প্রেসিডেন্ট এর আইটি বিষয়ক উপদেস্টা!
- তাই নাকি! কি বলছ?
- স্যার, ওয়ার্ল্ড স্ট্রীট জার্নালের এডিটর তো মান্দি মেয়ে, জানেন?
- তাই নাকি! কে এই মেয়ে?
- ওর নাম অদ্রি সাংমা। আপনার ছাত্রী কিন্তু সেও।
- আর সিলচির কথা জানেন, স্যার?
- নাহ!
- সে যুগ্ম সচিব ছিলো। এইবার মধুপুর টাঙ্গাইল-১ আসন থেকে এমপি হল! শিক্ষামন্ত্রী হতে পারে বলে পত্রিকায় লেখালেখি হচ্ছে। সেও কিন্তু পিএইচডি করা পাব্লিক!
- একজন বাঙালি ছেলে ছিল না তোমাদের ক্লাশে? তপু রাহমান?
- ও হ্যা স্যার। তার মা কিন্তু মান্দি, জানেন স্যার? সেই তো এখন প্রধান ইলেকশান কমিশনার!
- আর রুনা নামে আরেক জন বাঙালি মেয়ে ছিলো যে!
- ও ত এখন আমেরিকায়। সেও ত সিনেটর!
- একজন চাকমা ছেলে ছিলো...
- জি স্যার, উচি মং? সে তো এখন ওয়ার্ল্ড ব্যাংক এর পরিচালক! জানেন না স্যার?
- পত্রিকায় নাম দেখি। কিন্তু এরা যে সব আমার ছাত্র-ছাত্রী তা চিন্তাও করিনি!
  পল নামের ছেলে টা ?
- সে ত বিশপ ছিলো হালুয়াঘাট ডায়োসিসের। বাংলাদেশ থেকে যে প্রথম কার্ডিনাল হচ্ছে, ঐ তো আমাদের পল সাংমা, স্যার!
আর ময়মনসিংহ নটর ডেম কলেজের প্রিন্সিপাল নকরেক ওয়ারী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গত বছর তিন আগেই আইন বিভাগে এসোসিয়েট প্রফেসর হিসেবে জয়েন করেছিল। ব্যারিস্টারি শেষ করে ফিরলো লন্ডন থেকে গত মাস! শোনা যাচ্ছে ভিসি হয়ে যাবেন। প্রধান মন্ত্রীর বক্তব্য লিখে দেওয়ার কাজ সেই তো করে আসছে! ঐ যে স্যার যে সব সময় বিতর্কে আমাকে হারিয়ে দিত! বিরিশিরিটাও ডায়োসিস হয়ে যাবে, জানেন?
- কেউ বলেনি এসব আমাকে!
- আর প্রায় প্রত্যেক দৈনিক পত্রিকাতেই আপনার স্টুডেন্ট আছে। টাইমস ম্যাগাজিনেও তো ডেপুটি এডিটর আচিক ছেলে!
- ও! পুলিশ, সেনাবাহিনীতে কেউ নেই?
- কত আছে স্যার। টাঙ্গাইল আর ময়মনসিংহ জেলার এস পি তো আমাদেরই ক্লাসমেট। আর সেনাবাহিনীতে ওয়ানগালা চিরান আর ওয়ালজান আছে।
- আমি সেই কবে দেশ ছেড়েছি! আসলে দেশের খবর রাখিনি আর... আচ্ছা, সালজং নামে একজন ছেলে ছিলো, তোমাদের সিনিয়র; সে কি করে?
- উনিই ত স্পীকার এখন স্যার!
- তোমরা তো পৃথিবী দাপিয়ে বেড়াচ্ছ দেখছি!
- জি স্যার। সব তো আপনার ত্যাগ আর সীমাহীন ভালোবাসার ফসল!
- পাগল ছেলে। তুমি ট্র্যাকের বাইরে চলে যাচ্ছ!
- স্যরি স্যার। স্যার আগামী বছর তো জাতি সংঘের বর্তমান মহাসচিব এর সেকেন্ড টার্ম শেষ হয়ে যাচ্ছে। ডিপ্লোমেটিক জোনে কিন্তু সিল্গা-র নাম খুব আলোচিত। আমরা পেয়েও যেতে পারি বাংলাদেশ থেকে একজন মহাসচিব স্যার, দোয়া করবেন! আপনি স্বপ্ন দেখতেন না একদিন বাংলাদেশী আচিক ছেলে বা মেয়ে জাতি সংঘের মহাসচিব হবে? আমার মনে হয় আমরা সে স্বপ্ন পূরণের দ্বারপ্রান্তে!
এইবার আমি সত্যি কেঁদে উঠলাম! এই কান্না একটি স্বপ্ন হারিয়ে অনেক স্বপ্ন খুঁজে পাওয়ার কান্না! 'ছেলেদের কাঁদতে নেই' বলে নিজেকে বুঝাতে গিয়েও আর বুঝাতে পারিনি! আজ নিজেকে দিয়েই বুঝলাম ছেলে মানুষেরাও কাঁদে...
আসলে আজ আমার কাঁদবারই দিন। বাড়ির বাইরে বের হয়ে দেখি আকাশজুড়ে আজ জোছনা বৃষ্টি। এতটুকু মেঘ নেই আজ। মনের অজান্তে আমি একটি স্বপ্নের হাত ধরি! গুনগুন করে মুখ দিয়ে সুর বেরিয়ে আসে, 'আনন্দ ধারা বহিছে ভূবনে...


পুনশ্চঃ গল্পটি কাল্পনিক। 

No comments: